২০২৫ সালে স্বর্ণের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি: বৈশ্বিক ঝুঁকি ও মন্দার আশঙ্কায় বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ আশ্রয়
২০২৫ সালজুড়ে স্বর্ণের মূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে, যা বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও বাজারে অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সম্পদে পরিণত হয়েছে। ২০২২ সালের শেষ দিকে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকেই স্বর্ণের দাম ঊর্ধ্বমুখী, এবং এখন তা এক টানা ঊর্ধ্বগতিতে রয়েছে।
২০২৫ সালে স্বর্ণের দরবৃদ্ধির পেছনে আরও একটি বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য দ্বন্দ্ব। গত সপ্তাহে স্বর্ণের মূল্য সর্বকালের সর্বোচ্চ $৩,২৪৫-এ পৌঁছেছে। নিরাপদ বিনিয়োগের প্রতি চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণেই এমন রেকর্ড তৈরি হয়েছে।
চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি আউন্সে স্বর্ণের মূল্য $৬০০ বেড়েছে। ১ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে স্বর্ণের দাম ছিল $২,৬২৩, যা ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে $৩,২২৩-এ — মাত্র সাড়ে তিন মাসে প্রায় ২৩ শতাংশের লাফ।
ভারতের বাজারে ১ জানুয়ারিতে ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের দাম ছিল ₹৭৮,০০০, আর এখন তা বেড়ে ₹৯৩,৮৬০ হয়েছে। অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রায় স্বর্ণের দাম বেড়েছে ২০.৩%।
বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তা বাড়লে বিনিয়োগকারীরা সাধারণত নিরাপদ সম্পদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই কারণেই গত ২-৩ বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, শিল্প প্রতিষ্ঠান, বৈশ্বিক ইটিএফ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন। বিশ্লেষকদের মতে, যদিও মাঝেমধ্যে লাভ তুলে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যেতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে স্বর্ণ একটি শক্তিশালী সম্পদ হিসেবে অবস্থান ধরে রাখবে।
এদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের ট্যারিফ নীতির ভবিষ্যৎও স্বর্ণের দামে প্রভাব ফেলছে। কিছুদিন আগেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীন থেকে আমদানি হওয়া ইলেকট্রনিক পণ্যে শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা দিলেও, বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক জানিয়েছেন যে আগামী দুই মাসের মধ্যে ইলেকট্রনিক পণ্য ও সেমিকন্ডাক্টরগুলোর ওপর নতুন শুল্ক আরোপ করা হবে। ইতিমধ্যে চীনা পণ্যের ওপর ট্রাম্প প্রশাসন ১৪৫% শুল্ক বসিয়েছে, যার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় চীনও মার্কিন পণ্যের ওপর ১২৫% শুল্ক বসিয়েছে।
এই পরিস্থিতি স্বর্ণের চাহিদাকে আরও তীব্র করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আসন্ন ফেডারেল রিজার্ভের আর্থিক নীতিনির্ধারণ সভা। যদি চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী প্রবণতার ভিত্তিতে নমনীয় মনোভাব প্রকাশ করেন, তাহলে তা স্বর্ণের দামের জন্য ইতিবাচক হবে। তবে, পাওয়েলের ভাষ্যমতে শুল্ক কার্যকর হলে মূল্যস্ফীতি আবারও বাড়তে পারে, যা সুদের হার দীর্ঘ সময়ের জন্য উঁচু রাখার পক্ষে যাবে — এবং এটি স্বর্ণের দামের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
তবু বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার সম্ভাবনা স্বর্ণের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দিচ্ছে। একই সঙ্গে বন্ড বাজারে বিক্রির চাপও স্বর্ণকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
যুদ্ধ বা বাণিজ্য দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত কোনো পক্ষই প্রকৃত বিজয়ী হয় না। ইতোমধ্যে মার্কিন ডলারের দুর্বলতা পরিষ্কার — গত তিন বছরে ডলার সূচক ১০০-এর নিচে নেমে এসেছে। ডলারের এই দুর্বলতাও স্বর্ণের দামের পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করছে।