">
সাম্প্রতিককালে প্রায় সবাই শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এবং কেউ কেউ এজন্য শিক্ষকদের দায়ীও করছেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করছি।শিক্ষার প্রাণভ্রোমরা হচ্ছেন শিক্ষক। কাজেই শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা ভাবতে গেলে প্রথমে ভাবতে হবে শিক্ষকদের মানোন্নয়নের বিষয়টি। তাছাড়া পাঠ্যপুস্তক, পরীক্ষা পদ্ধতি, অবকাঠামো, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি, অভিভাবক ইত্যাদির ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষকের কথা ভাবতে গেলে কবি কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতায় বর্ণিত শিক্ষকের প্রতিচ্ছবিই আমার মানসপটে ভেসে ওঠে, যেখানে কবি শিক্ষককে সবার শ্রেষ্ঠ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আমরা কি শ্রেষ্ঠ মেধাবীকে (মানুষকে) শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে পেরেছি কিংবা পারছি?
আমাদের দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ৯৭-৯৮ শতাংশ বিদ্যালয় স্থানীয়ভাবে ম্যানেজিং কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়, যদিও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, অবকাঠামো উন্নয়ন সরকারই করে থাকে। বিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব যারা পালন করেন, তারা সাধারণভাবে সমাজের উন্নত অংশের প্রতিনিধি। তাদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব আইন দ্বারা বর্ণিত। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন, আর্থিক কিংবা প্রশাসনিক বিষয়ে কমিটি যতটা মনোযোগী, শিক্ষকের মানোন্নয়নের ব্যাপারে ততটা মনোযোগী কিংবা উদ্যোগী নয়। এর বাইরে ব্যক্তি মালিকানাধীন/পরিচালিত বেশকিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফল (জিপিএ-৫) অর্জন করছে এবং অভিভাবকরাও তাদের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। যদিও এসব প্রতিষ্ঠান নিুবিত্তের নাগালের বাইরে।
আগেকার দিনে শিক্ষার্থীর সামনে দৃশ্যমান সহায়তাকারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিলেন একমাত্র শিক্ষক। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্য। কিন্তু একুশ শতকে তথ্যপ্রযুক্তি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে কিছুটা ভিন্নমাত্রা এনে দিয়েছে। একই সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষার্থীর পাশাপাশি অভিভাবকও (বিশেষ করে মায়েরা) শিক্ষার্থীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন, যা প্রকৃত শিক্ষার্থীর আচরণে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অভিভাবকরা শিক্ষকের কাছে তাদের সন্তানের কেবল সবচেয়ে ভালো ফল (গোল্ডেন জিপিএ) প্রত্যাশা করেন, আর এজন্য উদয়-অস্ত প্রাইভেট টিউটর, কোচিং সেন্টার, স্কুল ইত্যাদির পেছনে ছুটছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরীক্ষার্থীরা (শিক্ষার্থী নয়) প্রত্যাশিত ফল (জিপিএ-৫) অর্জন করছে। তারপরও আমরা শিক্ষার মান নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছি না।
আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, ছাত্ররা স্কুলে ফুলটাইম থাকতে চায় না কিংবা স্কুল ছাত্রদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। এক্ষেত্রে স্কুল, শিক্ষক, অভিভাবক, ছাত্র কিংবা কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট টিউটর কতটা দায়ী? এখনও বাবা-মায়ের প্রথম পছন্দ কিন্তু স্কুল, কোচিং সেন্টার কিংবা প্রাইভেট টিউটর নয়। পছন্দের স্কুলে সন্তানকে ভর্তির জন্য সারা বছর বাবা-মায়ের কী পরিশ্রম, উৎকণ্ঠা! সেই কাক্সিক্ষত স্কুলে সন্তানকে ভর্তির পর (যদিও সবাই ভর্তির সুযোগ পায় না) যদি সেই স্কুলে শিক্ষার্থী ফুলটাইম থাকতে না চায় তাহলে বিষয়টি উদ্বেগজনক।
স্কুলকে নির্ভয়, নির্মল আনন্দময় ও শিক্ষার্থীদের ভরসার আশ্রয়স্থলে পরিণত করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের উপযোগী পরিচর্যা কেন্দ্রে পরিণত করা উচিত। স্কুল যেন হয় শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখার উত্তম চর্চাকেন্দ্র। স্কুল কেবল জিপিএ-৫ পাওয়ার প্রতিযোগিতা কেন্দ্র যেন না হয়।
প্রতিযোগিতার মানদণ্ডে শিক্ষকতা এখন একটি ভালো পেশা। ইদানীং কেউ কেউ শিক্ষকতাকে অন্যান্য পেশার সঙ্গে এক করে দেখছেন কিংবা তুলনা করছেন। আবার কেউ কেউ শিক্ষকতায় আগের গৌরব-সম্মান নেই বলে মন্তব্য করছেন। কিন্তু শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা (চাকরি) নয়, বরং শিক্ষকতা একটি ব্রত। একজন শিক্ষকই পারেন শিক্ষার্থীর মনোজাগতিক পরিচর্চার মাধ্যমে তাকে একজন পূর্ণ, সুস্থ ও কাক্সিক্ষত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত থাকলেই সবাই সম্মান করবে, শ্রদ্ধা করবে কিংবা শ্রেষ্ঠ মানুষ ভাববে, বিষয়টি বোধহয় এমন নয়। শ্রদ্ধা, সস্মান অর্জন করতে হয়। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে শিক্ষকতা আজ সত্যিই চ্যালেঞ্জিং। আমার বিশ্বাস, আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ শিক্ষকই হবেন একুশ শতকের শিক্ষার্থীদের আদর্শ।
মো. রফিকুল ইসলাম : জেলা শিক্ষা অফিসার, ময়মনসিংহ
About Us Contact Privacy & Policy DMCA Sitemap
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত | সেরা নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম -২০১৮